• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

সারা দেশ

নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না চালের দাম

  • ''
  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০২৪

তরিকুল ইসলাম সুমন:

চালের বাজার সহনীয় এবং দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে সরকার চাল রফতানি বন্ধ করার পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি, বস্তায় ধানের জাত ও মূল্য লেখা নির্দেশনা জারি, অভিযান পরিচালনাসহ নানা উদ্যোগ নিলেও কোনোভাবেই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না। যে যার মতো করে চালের দাম নির্ধারণ করছে। মানছে না সরকারি কোনো নির্দেশনাও।

সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয় বস্তায় ধানের জাত ও মূল্য লেখা নির্দেশনা জারি করলেও তা উপেক্ষা করছে মিল মালিকরা। চালের বস্তার গায়ে ধানের জাত, মিলের ঠিকানা ও দাম লেখা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রলণালয় পরিপত্র জারি করেছিল। ১৪ এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর করতে বলেছিল মন্ত্রণালয়। এই হিসেবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীরা সময় পেয়েছিলেন ৫৩ দিন। সরেজমিন বিভন্ন বাজার ঘুরে ও রাইস মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা কার্যকর করা তাদের পক্ষে এখনও সম্ভব হয়নি। আরও এক মাসের মতো সময় লাগবে এই নির্দেশনা কার্যকর করতে। মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

নির্দেশনায় বলা হয়, চালের বস্তায় ধানের জাত ও মিল গেটের মূল্য লিখতে হবে। সেই সঙ্গে লিখতে হবে উৎপাদনের তারিখ ও প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নাম। উল্লেখ করতে হবে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের অবস্থানও (জেলা ও উপজেলা)। ওজনের তথ্যও থাকতে হবে।

নির্দেশনায় বলা হয়, সম্প্রতি দেশের চাল উৎপাদনকারী কয়েকটি জেলায় পরিদর্শন করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, বাজারে একই জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে ও দামে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে গেলে বা হঠাৎ বৃদ্ধি পেলে মিলার, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। এতে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে পছন্দমতো জাতের ধানের চাল কিনতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থার উত্তরণের লক্ষ্যে চালের বাজারমূল্য সহনশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে ধানের নামেই যাতে চাল বাজারজাতকরণ করা হয় তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিংয়ের সুবিধার্থে নির্দেশনায় কয়েকটি বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে চালের উৎপাদনকারী মিল মালিকদের গুদাম থেকে বাণিজ্যিক কাজে চাল সরবরাহের প্রাক্কালে চালের বস্তার ওপর উৎপাদনকারী মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদনের তারিখ, মিল গেট মূল্য এবং ধান/চালের জাত উল্লেখ করতে হবে। বস্তার ওপর এসব তথ্য হাতে লেখা যাবে না। চাল উৎপাদনকারী মিল মালিকের সরবরাহ করা সব ধরনের চালের বস্তা ও প্যাকেটে ওজন উল্লেখ থাকতে হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে।

এক্ষেত্রে মিল গেট দামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান চাইলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ করতে পারবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২৩-এর ধারা ৬ ও ধারা ৭ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনটির ধারা-৬-এর অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার সুযোগ রয়েছে। আর ধারা-৭-এর শাস্তি হিসেবে রয়েছে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্রের আলোকে সব জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, খাদ্য পরিদর্শকরা পরিদর্শনকালে এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

এ প্রসঙ্গে বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহা. রফিকুল ইসলাম বলেন, খাদ্য মন্ত্রণায়ের পরিপত্রের কপি পেয়েছি। আমরা কাজ শুরু করছি। আজকে অফিস শুরু হয়েছে। আমরা এটা কঠোরভাবে মনিটরিং করব।

কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্দেশনা দিলেই তো হয় না। কার্যকর করার জন্য সময় লাগবে। এখন যে পুরনো বস্তা আছে সেগুলো কী করবেন ব্যবসায়ীরা। সামনে যখন নতুন চাল আসবে তখন থেকে এটা মিল মালিকরা কার্যকর করলে আমরা সেই বস্তা পাব। আমরা তো আর চালের বস্তা তৈরি করি না। আমরা তো আড়তদারদের থেকে কিনে আনি।

মেসার্স মান্নান রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মান্নান তালুকদার বলেন, ‘নতুন ধান উঠলে এটা তখন থেকে কার্যকর হলে ভালো হবে। আর মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা উৎপাদনের স্থান থেকে কার্যকর হবে। তবে আমাদের স্টকে বা দোকানে যে চাল আছে তা বিক্রি শেষ না হলে আমরা তো নতুন চালের বস্তা আনতে পারব না। এটা কার্যকর হলে ভোক্তার জন্যও সুবিধা হবে। তবে এটা কার্যকর করতে পারবে কী না সেটাই বড় কথা।

নওগাঁর দেশ অটোমেটিক রাইস মিলের ম্যানেজার সুমন্ত কুমার কুণ্ডু বলেন, আমরা বস্তার প্রিন্টিং অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। নতুন চাল উঠলেই আমরা নতুনভাবে করব। নতুন চাল উঠতে আরও অন্তত ২০ দিন সময় লাগবে। আর বিভিন্ন কোম্পানির আগের বস্তাগুলো তো রয়ে গেছে। এগুলো তো আর কেউ নষ্ট করতে পারবে না। এখানে বহু টাকার ব্যাপার। পুরনো বস্তা শেষ হতে হতে এক মাস লাগবে। এরপর নতুন বস্তায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক করা হবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেসার্স মুনজুর অটো রাইস মিলের পরিচালক ফারুখ হোসেন বলেন, সরকারের নির্দেশনা আমাদের অবশ্যই মানতে হবে। আমাদের নতুন সিজন থেকে যে চালটা যাবে, ওই বস্তায় ধানে জাত ও দামসহ নির্দেশনা মোতাবেক লেখা থাকবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত পরিপত্র বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, চালকল মালিকরা সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। মন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। সময় কিছুদিন বাড়ানো হতে পারে। তবে এখনই কনফার্ম করতে পারছি না।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আধিদপ্তর সূত্র জানায়, চালের বস্তায় দাম লেখার যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা অবশ্যই মিল মালিকদের মানতে হবে। অধিদপ্তর প্রয়োজনীয় নির্দেশনার অপেক্ষায় আছে। নির্দেশনা পেলেই অভিযান পরিচালনা করা হবে। এটির কোনো ব্যত্যয় পেলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বস্তায় ধানের জাত ও মূল্য লেখার নতুন যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তা বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নে একটি কমিটি কাজ করছে। আগামী ২৩ এপ্রিল এই কমিটি একটি বৈঠক করবে। সেখানেই প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা আসতে পারে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারিভাবে মার্চ ও এপ্রিল মাসে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ২ দশমিক ৭ লাখ মে.টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ২১ মার্চ ৩০ প্রতিষ্ঠানকে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে চাল বাজার জাতকরণের শর্তে ৮৩ হাজার মে.টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছিল। গতকাল (১৬ এপ্রিল) ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫ মের মধ্যে চাল বাজারজাত করার শর্ত দিয়ে ১ দশমিক ২৪ লাখ মে.টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায় ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে চালের মজুত ছিল ৮ লাখ ৯৩ হাজার মে. টন। ধান ৭৯৭ মে. টন। অপরদিকে গমের মজুত ছিল ৩ লাখ ২৯ হাজার ৬৬১ মে.টন। ২৩-২৪ অর্থ বছরে দেশে আমন সংগ্রহ করা হয়েছিল চাল (সিদ্ধ) ৫ লাখ ৪৯ হাজার ৩৪৮ মে.টন। আতপ চাল সংগ্রহ করা হয়েছে ৯৩ হাজার ৯০৭ মে.টন এবং ধান সংগ্রহ করা হয়েছিল ২৩ হাজার ৭৯৮ মে. টন। আমদানি পরিস্থতি বিষয়ে জানা গেছে, গত জুলাই থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনো চাল আমদানি হয়নি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads